বিনোদন

অন্যরকম নুহাশ1 min read

এপ্রিল ২৯, ২০১৯ 4 min read

author:

অন্যরকম নুহাশ1 min read

Reading Time: 4 minutes

“কেউ মারা গেলে মানুষ ওই সিনেমাটিক কান্না কাঁদেনা। নাটকের কান্না কাঁদে… নিতে পারছিলাম না। তাই রান্না করলাম,  ৭০০ জনের জন্য কাচ্চি। তাদের খাওয়া সেরা কাচ্চি।

রান্না এক ধরণের কন্ট্রোলে থাকা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও নিজেকে তো যায়। সময় যেমনই যাক, আমরাতো ভালো থাকতে পারি।”

আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে এই সংলাপের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ‘হোটেল আলবাট্রস’। ২০১৭ এর সেপ্টেম্বর, ঈদের মৌসুমে মেজবাউর রহমান সুমন আর অমিতাভ রেজার উদ্যোগে ৭ তরুণ নির্মাতা নিয়ে আসে ‘অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প।  তারই একজন নুহাশ হুমায়ূন।

ভাবছেন, ‘হোটেল আলবাট্রস’ দিয়ে কেন পরিচয় করাতে হবে নুহাশকে? হুমায়ূন আহমেদের জ্যেষ্ঠ পুত্র বললেই তো চুকে যায়। অথবা নুহাশের চাচা মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা আহসান হাবীব – এটুকু বলাই তো যথেষ্ট!

না। নুহাশের পরিচয়টা অন্য। পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরেও তার কাজ,  ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়ে এক অনন্য নুহাশের কথাই জানাবো আজ।

বাবা হুমায়ূন আহমেদের সাথে শিশু নুহাশ;
Image Source: নুহাশ হুমায়ূনের ফেসবুক প্রোফাইল

যাত্রা শুরুর গল্প 

বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এবং গুলতেকিন খানের একমাত্র পুত্র নুহাশ হুমায়ূন। তিন বোনের ভীষণ আদরের ছেলেটির কথা নানান সময়ে উঠে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের নানান কর্মে, লেখনীতে। শৈশব,  কৈশোরের বিকেল-সন্ধ্যা যাদের কেটেছে হুমায়ূনের লেখা পড়ে ; তারা কম বেশি সবাই জানেন নুহাশের নাম। আর গাজীপুরে অবস্থিত হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত বাগানবাড়ি ‘নুহাশ পল্লী’র সবুজঘেরা প্রকৃতি আর ‘নুহাশ চলচ্চিত্র’ এর কথাতো সবারই জানা।

কিন্তু এতো গেল পারিবারিক পরিচিতি। অন্তর্মুখী স্বভাবের নুহাশের আছে নিজস্ব পরিচয়। পরিচয়টা একইসাথে একজন নির্মাতা, কার্টুনিস্ট অথবা নাট্যকার হিসেবে।

বাবার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকলে কী হবে, নুহাশ অনেকটা সময় পর্যন্ত সেটার আঁচ পাননি। পেয়েছেন বেশ পরে। কারণ স্কুল জীবন শুরু হয় রাজধানীর ‘সানবিমস স্কুলে’। ইংলিশ মিডিয়াম হওয়ায় বন্ধুদের তেমন কেউই বাংলা সাহিত্যের খোঁজ রাখতো না। তাই আলাদা করে হুমায়ূন আহমেদের ছেলে সেই পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়নি।

প্রেরণার শুরু

স্কুলে থাকতেই লেখালেখির হাত যে ভালো সেটা টের পাচ্ছিলেন নুহাশ। পরীক্ষায় সেরা না হলেও তার লেখা রচনা গুলো বন্ধুরা খুব মন দিয়ে পড়তো। তখনই গল্পের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দেয়ার তাগাদাটাই টের পেলেন নিজের ভেতর।

তবে আজকের অবস্থানে আসার পেছনে সবচাইতে বেশি অবদান মনে করেন মা গুলতেকিন খানের। নুহাশের যখন ১৩ বছর বয়স তখন তার মা একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে আনেন। নির্মাণের হাতে খড়ি সেই ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়েই। বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই এটা সেটা ভিডিও করতেন, গল্প বলতে চাইতেন এর মধ্য দিয়ে। এরপরেই মাথায় আসে ভিডিও এডিটিং শেখার। নিজের চেষ্টায় অনেকটা শিখেও ফেলেন।

তবে এরপরে খানিকটা বিরতি আসে যখন এ লেভেল শেষ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের ভিলেনোভা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পান। ভিলেনোভার মনোরম পরিবেশ অবশ্য এক বছরের মাথাতেই ছেড়ে চলে আসেন। ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে- পদার্থবিজ্ঞানে।

অনুপ্রেরণায় সবসময় এগিয়ে ছিলেন মা গুলতেকিন খান
Image Source: নুহাশ হুমায়ূনের ফেসবুক প্রোফাইল

হোটেল অ্যালবাট্রস

নতুনভাবে পড়াশোনা শুরু করলেও মন পড়েছিল ‘গল্প বলা’য়। তাই সিনেমা নির্মাণকেই বেছে নিলেন। পত্রিকায় কার্টুন এঁকে কিছু টাকা জমিয়ে নির্মাণ করলেন একটি শর্টফিল্ম। বহু নির্মাতাকে পাঠালেন সেই ফিল্মের ভিডিও, অনলাইনেও প্রকাশ করলেন। তবে সবদিক থেকেই নেতিবাচক সাড়া পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ছেড়ে দেবেন এই মাধ্যম। তখনই দেখা হয় নির্মাতা অমিতাভ রেজার সাথে। কথার ফাঁকে তাঁকে নিজের কাজ দেখাতেই পরামর্শ আর প্রশংসা পান। সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এর দুদিন পরেই অমিতাভ তাঁকে ফোন করে নাটক নির্মাণের প্রস্তাব দেন।

তারই ফলাফল ২০১৭ এর‘হোটেল আলবাট্রস’। মাত্র অল্প ক’জন অভিনেতা আর শক্তিশালী প্লট- সংলাপ দিয়ে যে অন্যভাবেও গল্প বলা যায় তা দেখিয়ে দিলেন প্রথম কাজেই। আর সাথে তো শক্তিমান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ছিলেনই। গল্প, পরিচালনা, সংলাপে অভিনবত্বের জোরেই বাজিমাত করে ফেলেন নুহাশ।

বায়োস্কোপে পিজ্জাভাই

বনানীতে তখন রাত সাড়ে তিনটা। গত একঘণ্টা যাবত নুহাশের বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে এক পিৎজা ডেলিভারি বয়। ঘুমের তোড় ভাঙতেই এ নিয়ে মাথায় এলো এক গল্প। ব্যস! আরেক নির্মাতা রাহাত রহমানকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে তৈরি করলেন  ‘পিজ্জাভাই’। কীভাবে এক পিৎজা ডেলিভারি বয় ড্রাগ ডিলারে পরিণত হয়- তা নিয়েই এগিয়ে চলে এর গল্প। বায়োস্কোপ অরিজিনালের ব্যানারে ব্যতিক্রমী নাম আর নির্মাণের জন্য এটিও পায় ভূয়সী প্রশংসা।

এছাড়াও ‘কাগজ খেলা’, ‘Dhaka Pocalypse’- প্রভৃতি শর্ট ফিল্মেরও রচয়িতা ও নির্মাতা তিনি। ২০১৭ সালে ‘পেপার ফ্রগস’ বা ‘কাগজ খেলা’ শর্ট ফিল্মটি ‘ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক’আয়োজিত ’Celebrating Life’ এওয়ার্ডে ‘বেস্ট ডেব্যু ফিল্ম ‘ এর খেতাবও পায়।

বিজ্ঞাপনে নুহাশ

নির্মাতা হিসেবে পরিচিতির আগে ২০১৪ সালে গ্রামীণ ফোনের একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় নুহাশকে। ‘Good News’ নামী  এই বিজ্ঞাপনটি বেশ নন্দিতও হয় সেসময়।

এবছর পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে,  বার্জারের আল্পনা ক্যাম্পেইনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিকোইল গ্রামকে নিয়ে বানিয়েছেন ৪ মিনিটের এক দৃষ্টিনন্দন ভিডিও।

৭০০ টাকা অথবা খোকা

হালের ক্রেজ প্রীতম হাসানের সাথে বোঝাপড়াটা দারুণ নুহাশের। এক সাথে কাজ করেছেন বেশ কটি প্রজেক্টেও। আইফ্লিক্সের শর্টফিল্ম ‘৭০০টাকা’ দিয়েই প্রথম জুটি বাঁধেন। সম্প্রতি প্রীতমের ‘খোকা’ গানটির মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছেন যা ইউটিউবে ৩.৭ মিলিয়নের বেশিবার দেখা হয়েছে।

ইতি, তোমারই ঢাকা

গত বছরের ৭ অক্টোবর ২৩ তম বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মুক্তি পায় বাংলাদেশের প্রথম অমনিবাস চলচ্চিত্র ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’। এই ছবিতে ১১টি ভিন্ন গল্প নিয়ে হাজির হন ১১জন তরুণ নির্মাতা। এর ‘The Background Artist’  অংশের পরিচালনা করেছেন নুহাশ।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জয়পুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে উদ্বোধনী ছবি ছিল এটি,  পাশাপাশি জিতে নিয়েছে অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে রপুরস্কারও।

সামনের ভাবনা

‘প্রথম আলো- ক্রাউন সিমেন্ট’ আয়োজিত তারুণ্যের জয়োৎসব-জাতীয় পর্বে ‘পেশাই শখ, শখই পেশা’ শীর্ষক আলোচনায় জানালেন দেশি সিনেমা নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের নিজস্ব ধারা তৈরিই তার মূল লক্ষ্য। গল্প বলায় নতুনত্বের পাশাপাশি নতুন কিছু শিখতেও আগ্রহী তিনি।

বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে নুহাশ হুমায়ূন নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাময় নক্ষত্র। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকলেও সম্পূর্ণ আলাদা স্টাইলে কাজ করার প্রতিই এই তরুণ নির্মাতার আগ্রহটা বেশি।

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *